amp

দুর্ঘটনা কখনোই আগে থেকে জানিয়ে ঘটেনা। যে কোন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র যে কোন মূহুর্ত্বে দুর্ঘটনার কবলে পরতে পারে। আমাদের মধ্যে যারা দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছি কিংবা স্বচোক্ষে দেখেছি তারা এর শেষ পরিনতি কি হতে পারে তা কম-বেশি সবাই জানি। সাধারণত কোন সমাজ বা রাষ্ট্র দুর্ঘটনায় পতিত হলে সমাধানের আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু কোন ব্যক্তি বা পরিবার দুর্ঘটনায় পতিত হলে আমরা ব্যক্তিগত, সামাজিক তখা রাষ্ট্রীয়ভাবে সঠিক কোন ব্যবস্থা নিতে আভ্যস্ত হতে পারিনি। অথচ, আমাদের উচিৎ, দুর্ঘটনায় কবলে পরা মানুষের পাশে থেকে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, সহযোগিতাপূর্ন আচরণ করা, সুহৃৎ সম্পর্ক স্থাপন করা ও যতটা সম্ভব পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। মানুষ মাত্রই যেকোন মূহুর্ত্বে দুর্ঘটনার কবলে পরতে পারে যা কোনভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের প্রত্যেকেরই ভালভাবে তা অনুধাবন করা উচিৎ। কেননা, একটি দুর্ঘটনা যে কোন ব্যক্তি বা পরিবারকে মূহুর্ত্বের মধ্যে স্বাভাবিক সুন্দর সাজানো জীবন-যাপনের পথ থেকে দুর্ভোগময় অস্বাভাবিক জীবনে ছিটকে ফেলে দিতে পারে। দুর্ঘটনায় পতিত মানুষের বেদনাসিক্ত জীবন-যাপন কতটা হৃদয় বিদারক হতে পারে তা আমরা কখনো জানতেও চাইনা।



শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদেই দুর্ঘটনার কবলে পরা ব্যক্তিকে সারাটি জীবন প্রতিটি পদে অসহনীয়-চরম যাতনা নিরবে সহ্য করে অতিবাহিত করতে হয়। অথচ, দুর্যোগে পরিপূর্ন সেই জীবনের যন্ত্রণা-কাতর প্রতিটি মূহুর্ত্বকে আমাদের সমাজে কেন যেন অতি স্বাভাবিক বিষয় বলে গণ্য করা হয়। আর, তাই হয়তো, আমাদের সামাজিক বলয়ের মাঝে আমাদের চারপাশেই তারা করুন পরিনতিকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। অনাদরে অবহেলায় কন্টকাকীর্ন অসম জীবন অতিবাহিত করার মহাযুদ্ধের যোদ্ধা হয়ে কোন রকমভাবে বেঁচে থাকে।



আমরা বিভিন্ন শ্রেণীর ও পেশার মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে মিলেমিশে বাস করি। আর্থিক সামর্থ্য সম্পন্ন, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয় স্বজনের মধ্যে পারিবারিক এক অনাবিল মেলবন্ধন ও সামাজিক সখ্যতায় পরিপূর্ন ব্যক্তি বা পরিবার আমাদের সমাজে আছে। যাদের কেউ আকষ্মাৎ কোন দুর্ঘটনার কবলে পরে নিঃস্ব জীবন নিয়ে কবে কিভাবে কখন আমাদের চোখের আড়ালে কোথায় চলে গেছে তা আমরা লক্ষ্য করতে পারিনি।


এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, একজন ব্যক্তি হতে পারে স্বচ্ছল, মেধাবী, অঢেল অর্থ সম্পত্তির মালিক, বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় ভাবে গুরুত্বপূর্ন হলেও শুধুমাত্র কোন দুর্ঘটনার (সড়ক দুর্ঘটনা, নৌকাডুবিতে, ঝড়, ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস, আততায়ীর হাতে নিহত, বোমা বিস্ফোরণ, হঠাৎ মৃত্যু) কারনে তাঁর জীবনের সমস্ত কিছু উলট-পালট হয়ে যেতে পারে। একটি দুর্ঘটনা তাঁর মেধাবী এবং আন্তর্জাতিক মানের কোন স্কুল বা কলেজে অধ্যয়নরত সন্তানকে মূহুর্ত্বের মধ্যে ছিটকে ফেলে দিতে পারে পেটের দায় মেটানোর তা‌গিদে কোন দিন মজুর হিসাবে। স্ত্রী, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনের সকল বন্ধন ছিন্ন করে পরিনত করতে পারে ভিন্ন ভিন্ন জীবনের অস্বাভাবিক পরিবেশের কোন মানুষে।



আমরা কেউ দরিদ্র আবার কেউ বিত্তশালী। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ সব শ্রেণীর মানুষ একসাথে বসবাস করলেও আমরা যার যার অবস্থানে থেকে সুখে-শান্তিতে থাকতে আজীবন সংগ্রাম করে যাই। কিন্তু, আমাদের এই সংগ্রামের উদ্দেশ্য কি আসলেই স্বাভাবিক? কারন, আমাদের এই সংগ্রাম মূলতঃ অন্যকে হাড়িয়ে নিজেকে বিজয়ী করার বিশেষ অপতৎপরতা ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বার্থপরের মত ডানে-বামে কারো দু:খ-দুর্দশার কথা কেন চিন্তাই করতে পারি না? স্বার্থ ছাড়া অন্যের যে কোন বিষয়কে ঝামেলা মনে করি। এ সমাজে আমাদের ডানে-বামে অসংখ্য অসহায়, দু:খ-দর্দশাগ্রস্থ্য মানুষ রয়েছে যাদের দিকে বিন্দুমাত্র সময়ের জন্য চোখ তুলে তাকালে বা হাতটা বাড়িয়ে দিলে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে তারা সুখ-সমৃদ্ধির জীবনের অধিকারী হতে পারে। আবার, আমাদের কিঞ্চিত গাফিলতি, অবহেলা, এড়িয়ে যাওয়া, জুলুম-অত্যাচার, লোলুপ দৃষ্টির কারনে নি:শেষ হয়ে যেতে পারে তাদের শেষ সম্বল দুঃখগাঁথা জীবনটা।



শুধু আত্মচিন্তায় নিমগ্ন থেকে আমরা সবাই যেভাবে পারি যার যার মত সংসার সাজাই, ভবিষ্যৎ গড়ি, নিজের সুবিধার জন্য অন্যের সাথে সম্পর্ক করি, নিজের ক্ষীণ স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে পিতা-মাতাকে পর্যন্ত  দুরে ঠেলে দিতেও কুন্ঠাবোধ করিনা, ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ বাড়াই, অজানা অচেনা কাউকে পরম আত্মীয় করে যেমন বুকে টেনে নিয়ে থাকি তেমনি প্রয়োজন হলে কপালে লাথি মেরে ফেলে দেই। ভদ্রতার মুখোশ দিয়ে আমাদের ভিতরের পশুকে সযত্নে লালন করি। নিজেদের মত করে পরস্পরের সাথে উদ্দেশ্য প্রনো‌দিত আচার-ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু আমরা যাই-ই করি না কেন যেকোন দুর্ঘটনার কারনে আমাদের নিজ হাতে সাজানো সমস্ত কিছুই মূহুর্ত্বের মধ্যে তছনছ হয়ে যেতে পারে। যত বড়াই, আত্ম-অহমিকা, লোভ-লালসা, হিংসা, হানাহানি, মারামারি, খুন-ধর্ষণ, প্রতারণা, জুলুম-অত্যাচার করে কেউ কি আমাদের মনের ক্যানভাসে আঁকা ভবিষ্যৎ গন্তব্যে পৌঁছানোর বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা দিতে পারি?



একটি দুর্ঘটনা যদি যে কোন মানুষের সাজানো সংসার, তিলে তিলে গড়া ভবিষ্যৎ, পরিবার-পরিজন, আদর-ভালবাসাসহ সবকিছু মূহুর্ত্বের মধ্যে তছনছ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে তাহলে আর বড়াই করার কি বা অর্থ থাকতে পারে? লোভের আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে কি লাভ?



সত্যিকার অর্থে সমাজে আমাদের চারপাশে যে মানুষগুলোকে আমরা অবজ্ঞা আর অবহেলা করি, যাদেরকে নিচুস্তরের মানুষ বলে আখ্যায়িত করি, যাদের জীবন-যাপনের জন্য কোন  আর্থিক সাহায্যকে বিশেষ বরাদ্দ বলে বেশী মনে করি, সাহায্য চেয়ে হাত বাড়ালে যাদেরকে প্রতারক হিসাবে চিহ্নিত করি, তাদের প্রত্যেকের জীবনের নেপথ্যে রয়েছে করুন অধ্যায়। যে অধ্যায় রচিত হয়েছে উত্থান থেকে পতনের মধ্য দিয়ে, অনাবিল সুখ থেকে বিভৎস যন্ত্রণা বরণের মধ্য দিয়ে, অনুচ্চারিত হৃদয়বিদারক অসংখ্য বাক্যের সমন্বয়ে গঠিত অসমাপ্ত জীবন কাহিনীতে। শুধুমাত্র কোন দু্র্ঘটনাই তাদের সাজানো গোছানো স্বাভাবিক জীবনকে রূপান্তরিত করেছে মায়া-মমতাহীন দুঃখগাঁথা অসংখ্য করুন অধ্যায়ের এক মানবেতর জীবন-উপাখ্যান।



দশ টাকার একটি নোট হাতে পেয়ে এ সমাজে যারা আকাশের চাঁদ পেয়ে যাবার মত আনন্দিত হয়ে থাকে, তাদের চাহিদা সত্যি খুবই সীমিত। আমাদের চারপাশেই এমন অসহায় মানুষ রয়েছে যারা তুখোর ছাত্র বা ছাত্রী হয়েও জীবন চলার পথে কোন দুর্ঘটনার স্বীকার হয়ে পড়াশোনাকে আর চালিয়ে নিতে পারেনি। অথচ, এ সমাজে আমাদের মধ্যেই অনেকের সেই সব অসহায় ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয়ার সামর্থ্য থাকতেও নিতে পারিনা। কারন, অসহায়কে আমরা শুধু নির্যাতন, অবহেলা, অনাদর ও নিগৃহীত করতে শিখেছি, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শিখিনি। তাদের কল্যাণে আমরা বিন্দুমাত্র দায় বোধ করতে পারিনি, তবে অসহায়ের দুর্বলতার সুযোগ নেয়ার বিশেষ অপকৌশল আমাদের সবারই যেন ভালভাবে রপ্ত করা রয়েছে। অন্য সাধারণ মানুষের মত তাদের স্বাভাবিক জীবন আমরা চিন্তাও করতে পারিনা। এ সমাজে সভ্যতার মুখোশে আড়াল করে আমাদের মানবিকতাকে ঠেলে দিয়েছি করুন বিপর্যয়ের পথে। এমন হীনমন্যতাপূর্ন মানবতার  উদাহরণ শুধু আমরাই।

-এস আই খান

Comments

Popular posts from this blog

Chikungunya -Fact sheet

অসমাপ্ত কবিতা

সফল হতে নিজেকে নিচের ৯টি প্রশ্ন করতে পারেন, প্রতিদিন